ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট এর কাজ চলছে । সাইটটি ব্যবহারে অসুবিধার সম্মুখীন হলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত !!

বই রিভিউ

বই রিভিউ

‘আত্মহত্যা : মনস্তাত্ত্বিক আত্ম-যাতনার এক নির্মম বাস্তবায়ন’

বাংলাসাহিত্যে প্রায় অনুচ্চারিত ও বিচিত্র সববিষয় নিয়ে নিরলসভাবে একের পর এক গবেষণালব্ধ কাজ করে যাচ্ছেন লেখক এ.এন.এম. নূরুল হক। তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘মৃত্যু’, ‘বৃদ্ধাশ্রম’, ‘ব্রাত্যজন বৃত্তান্ত’, ‘ধর্ম-অধর্ম’ ইতোমধ্যে যেমন পাঠকসমাদৃত হয়েছে, তেমনি হয়েছে আলোচিত-সমালোচিতও।

লেখকের “আত্মহত্যা” বইটিও মানুষের যাপিত জীবনের সবচে রহস্যাবৃত কিংবা বিভীষিকাময় শব্দ ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে অভাবনীয় এক গবেষণালব্ধ বই। এমন বিযুক্ত বিষয়ের ওপর, এতো নিখুঁত তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ বই বাংলাসাহিত্যে খুবই বিরল। ‘আত্মহত্যা’ পাঠশেষে প্রতিটি পাঠক যে আত্ম-ভাবনায় তাড়িত হবেন তা হলো, স্রষ্টা প্রদত্ত এই ঐশ্বর্যগর্বিত জীবনের প্রতি এক নির্দয় অবিচারের নামই মূলত আত্মহত্যা।

‘আত্মহত্যা’ বইটি ২৪টি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে বিভক্ত। লেখক প্রতিটি পরিচ্ছেদ সাজিয়েছেন চমকপ্রদ ও তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়ভাবনায়। প্রতিটি শিরোনামে বিবৃত হয়েছে ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে লেখকের নিখুঁত তত্ত্বান্বেষণ। মানুষের সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত আত্মহত্যার উদ্ভব ও ব্যাপ্তি এবং অসাড়তা ও নিষ্ক্রিয়তাসহ— আত্মহত্যা নিরোধে গৃহীত আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক পদক্ষেপ ওঠে এসেছে বইটিতে। লেখক চেষ্টা করেছেন প্রহেলিকাচ্ছন্ন শব্দ আত্মহত্যার স্বরূপ সন্ধান করে তার ভয়াবহতা এবং অযৌক্তিকতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে। সাথে সচেষ্ট হয়েছেন আত্মহত্যা প্রতিকারে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধকরণে।

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই আত্মহত্যা ‘মহাকাশের কৃষ্ণবিবরের ন্যায়’ এক অমীমাংসিত রহস্যের নাম। যুগে যুগে আত্মহত্যা যেমন একটি গর্হিত কাজ বলে স্বীকৃত হয়েছে, তেমনি আবার আত্মহত্যার সমর্থন বা স্তুতিও লক্ষ্য করা গেছে। যেমন : ভাইকিং নামে পরিচিত নরওয়ের সমুদ্র-দস্যুদের বিশ্বাস ছিল, স্বর্গলাভের প্রধান শর্ত হলো যুদ্ধ অথবা আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ। আবার আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে প্রথা অনুসারে রাজার মৃত্যু হলে তাঁর দাসদাসী সবাইকে আত্মহত্যা করতে হতো পরলোকে রাজার সেবাযত্ন করবার জন্য। এসব হলো জীর্ণ ইতিহাসের জ্বলজ্যান্ত সাক্ষ্য।

তবে আত্মহত্যায় সবচে বেশি প্রলুব্ধ করেছেন উনিশ ও বিশ শতকের খ্যাতিমান অনেক কবি-সাহিত্যিকগণ। তাদের নিজেদের লেখায় যেমন আত্মহত্যা অনুরণিত হয়েছে এক মিহি বিষাদ-সুর হয়ে, তেমনি নিজেরাও আত্মহুতি দিয়েছেন সে সুরের মূর্ছনায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য অ্যান সেক্সটনের নাম। যিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘Live or Die’ এর জন্য অর্জন করেছেন পুলিৎজার পুরস্কার। নিযুক্ত হয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। রেজিস কলেজ যাকে ‘Doctor of Literature’ সম্মানে ভূষিত করে। তবুও এই যশ, এই খ্যাতি, এই অর্জন তাঁকে আত্মহত্যা থেকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি৷ ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর নিজেকে গাড়ির ভেতর আটকে রেখে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আত্মহত্যা করেন অ্যান সেক্সটন। ‘আত্মবিনাশী কবি-লেখক-শিল্পী’দের এই তালিকায় অ্যান সেক্সটনের মতো আরও আছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, ভার্জিনিয়া উলফ, জন কেনেডি টুল, ভিনসেন্ট উইলেম ভ্যান গখ, মেরিলিন মনরোসহ আরও অনেকে। ‘ঐতিহাসিক আত্মহত্যা’য় লেখক সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন, অ্যাডলফ হিটলার, রানি ক্লিওপেট্রা, সম্রাট নিরো এবং কাদম্বরী দেবীর আত্মহননে প্রলুব্ধ হবার ঘটনা।

বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ এবং সুবোধ সরকারসহ অনেকের লেখায় ‘আত্মহত্যা’ ধরা দিয়েছে এক নির্মম মর্ম-যাতনা হয়ে। কলকাতা শহরের ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে ট্রামের নিচে চাপা পড়া জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুও যেন অনন্তকালের এক অমীমাংসিত রহস্য। 

আত্মহত্যার বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর দিলে আঁতকে উঠতে হয়। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭ তে আত্মহত্যা করেছেন ৪৭ হাজার মানুষ। এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, ভূটান, ইউক্রেন, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি নামি-দামি রাষ্ট্রে আত্মহত্যায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে লাশের মিছিল। তাই আত্মহত্যা এখন এসব দেশসমূহে এক বিভীষিকাময় আতঙ্কের নাম। ইতোমধ্যে বিশ্বে প্রথমবারে মতো আত্মহত্যা প্রতিরোধে নতুন মন্ত্রণালয় গঠন ও মন্ত্রী নিয়োগ করেছে যুক্তরাজ্য। 

বাংলাদেশে আত্মহত্যার পরিস্থিতিও বেশ উদ্বেগজনক। দেশে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন প্রায় ১১ হাজার মানুষ। প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যা করেন ৩২ জন। এছাড়াও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ আছেন আত্মহত্যার ঝুঁকিতে।

বাংলাদেশের আত্মহত্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় লেখকের কিছু সাহসী উচ্চারণ পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের একাংশ পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফললাভে ব্যর্থ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। এক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্য হলো, ‘আমাদের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের বদলে শিখতে হয় জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ লাভের নানাবিধ কলাকৌশল।’ এছাড়াও ‘সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা মা-বাবার কাছে ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধে গঠিত হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্রাইসিস সেন্টার ও হেল্পলাইন সুবিধা। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সরকারি উদ্যোগ কিংবা বেসরকারি আয়োজন তেমন চোখে পড়ে না। এছাড়াও আত্মহত্যা প্রতিরোধকল্পে উল্লেখ করবার মতো কোনো পদক্ষেপই নেই এদেশে। এক্ষেত্রে লেখকের একটি পরামর্শ হুবহু তুলে ধরবার প্রয়োজনবোধ করছি। ‘বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথম করণীয় হচ্ছে, মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। যারা আত্মহত্যা করেন, তাদের ৮০ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত— এই কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ এই সত্যটি সম্পর্কে কিছুই অবহিত নয়। অবহিত ৪০ শতাংশের অর্ধেক মানুষ এই তথ্যটি সত্য বলে মানেন না।

মোট কথা, জেনে হোক বা না জেনে হোক, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ তাদের পরিবারের কোনো সদস্যের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে মনোরোগ চিকিৎসকের বদলে কবিরাজের কাছে ছুটেন। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার, মাদকাসক্তি ও বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, সঠিক সময়ে যথোপযুক্ত চিকিৎসা পেলে তাঁদের বাঁচানো সম্ভব হতো।’

সবশেষে বলা যায়, এ.এন.এম. নূরুল হকের ‘আত্মহত্যা’ বইটি পাঠ শেষে যেকোনো পাঠকের মনে হবে,  বাংলাসাহিত্যে তথ্যসমৃদ্ধ ও ভাষাগুণে ঋদ্ধ এক অনন্য গবেষণালব্ধ বইয়ের নাম আত্মহত্যা। যাতে লেখক ধূলিমলিন ইতিহাস, সুপ্রাচীন সাহিত্য আর ধ্বসে পড়া সভ্যতার গভীর থেকে তুলে এনেছেন আত্মহত্যার বিস্তৃত স্বরূপ এবং তা নিরোধে পর্যালোচনা করেছেন যথোপযুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা।

আত্মহত্যা মূলত মানুষের আত্ম-যাতনারই এক নির্মম বাস্তবায়ন। তবুও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ কিংবা ‘ভাল বাসিয়াছি এই জগতের আলো/জীবনেরে তাই বাসি ভাল’ অথবা বার্নাড শ’র মতো করেও বলা যায়, ‘জীবন এক বিস্ময়কর প্রাপ্তি। একে শেষ পর্যন্ত উপভোগ করা উচিত।’

বই : আত্মহত্যা 

লেখক : এ.এন.এম. নূরুল হক 

প্রকাশক : ঐতিহ্য 

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

২৬ এপ্রিল ২০২০